Loading

মাকে নিয়ে

শিশুকালে মায়ের কোলে আমি

আমার প্রয়াতা মায়ের নাম স্মৃতি কণা নন্দী। ১৯৩৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসে তৎকালীন অবিভক্ত ভারতের কলকাতায় একটি হাসপাতালে তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তাঁর বাবা-মা, মানে আমার মাতামহ অশ্বিনী কুমার দাশগুপ্ত আর মাতামহী জ্যোতির্ময়ী দাশগুপ্তা তখন কলকাতার চিৎপুর এলাকায়, জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির কাছে, একটা বাড়িতে থাকতেন বলে দিদিমা জ্যোতির্ময়ীর মুখে শুনেছি।

মায়ের বাপের বাড়ি চট্টগ্রাম জেলার বোয়ালখালী থানা (বর্তমানে উপজেলা)’র বিখ্যাত সারোয়াতলী গ্রামে। এ পরিবারের শ্রেষ্ঠ সন্তান ছিলেন আমার মাতামহের জ্যেঠামশায়, ব্রাহ্ম সমাজের আচার্য বেণীমাধব দাশ (গুপ্ত)। ইনি ছিলেন বসু ভ্রাতৃদ্বয় শরৎচন্দ্র-সুভাষচন্দ্র (নেতাজি)-এর শিক্ষাগুরু আর রাজনৈতিক দীক্ষাগুরু, এবং বিপ্লবী ভগ্নিদ্বয় কল্যাণী দাশ (ভট্টাচার্য) ও বীণা দাশ (ভৌমিক)-এর বাবা। ব্রিটিশ বিরোধী সশস্ত্র বিপ্লবের ইতিহাসে বিশেষ করে বীণা দাশের একটা উল্লেখযোগ্য স্থান রয়েছে। মুম্বই থেকে মুক্তিপ্রাপ্ত চট্টগ্রাম বিপ্লবভিত্তিক ছবি ’খেলেঁ হম জী জান সে’-তে বীণা দাশের বিপ্লবী ভূমিকাকে গুরুত্বের সঙ্গে তুলে ধরা হয়েছে। মায়ের এই পিসিমাটির সঙ্গে কবি জীবনানন্দ দাশের একটা হৃদয় বিনিময় গোছের সম্পর্ক ছিলো বলেও ছেলেবেলায় দিদিমার মুখে শুনেছি। এমনও শুনেছি যে, জীবনানন্দের বিখ্যাত ‘বনলতা সেন’ কবিতাটির পেছনে বীণা দাশের ছায়া আছে।

মায়ের মামাবাড়িও ছিলো সেই একই গ্রামে। এই মামাবাড়ি– সারোয়াতলীর নাগবাড়ি– একটা বিখ্যাত বাড়ি। এঁরা রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের অনুগৃহীত পরম ভক্ত দুর্গাচরণ নাগ মহাশয়দের গুষ্টিজ্ঞাতি। সম্ভবত উনিশ শতকের শেষের দিকে এঁরা ঢাকা জেলা থেকে চট্টগ্রামের সারোয়াতলীতে এসে বসত করেন। এ দেশের সশস্ত্র বিপ্লবী কর্মকাণ্ড, কম্যুনিস্ট আন্দোলন, প্রগতিশীল সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চা প্রভৃতির সঙ্গে এ বাড়ির সবসময়েই একটা ঘনিষ্ট যোগাযোগ ছিলো। মাস্টারদা সূর্য সেনের ঘনিষ্টতম সহচর লোকনাথ বল, তাঁর ছোটভাই হরিনারায়ণ বল ওরফে টেগরা, গণেশ ঘোষ, অনন্ত সিংহ, রামকৃষ্ণ বিশ্বাস প্রমুখেরা যেমন এ বাড়িতে সবসময় আশ্রয়-প্রশ্রয়, সাহায্য-সহযোগিতা পেয়েছেন, অনেক পরে ১৯৭১-এ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় অনুরূপ পেয়েছেন মুক্তিযোদ্ধারা। এ বাড়ি থেকেও আমরা পেয়েছি একাধিক সাহসী মুক্তিযোদ্ধাকে। কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়, সাহিত্যিক শওকত ওসমান, বিপ্লবী, কম্যুনিস্ট নেতা ও লেখক পূর্ণেন্দু দস্তিদার, আইপিটিএ’র গাইয়ে এবং প্রখ্যাত রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী কলিম শরাফী প্রমুখে অনেক বরেণ্য বামপন্থী, প্রগতিবাদী, স্বনামধন্য ব্যক্তিত্বের পদধূলি পড়েছে সারোয়াতলীর নাগবাড়িতে। ব্রিটিশ আমলে যেমন বিপ্লবীদের খোঁজে বার বার তাদের বাড়িতে হানা দিয়েছে ব্রিটিশ ভারতীয় ফৌজের হিংস্র গুর্খা সৈন্যেরা, তেমনি একাত্তরে মুক্তিযোদ্ধার খোঁজে হানা দিয়েছে নৃশংস পাকিস্তানি সৈন্যেরা। পঞ্চাশ জনেরও বেশি সদস্যের নাগ পরিবারের বিশাল বাড়ি জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ধ্বংস করে দেয়া হয়েছিলো মুক্তিযুদ্ধের সময়।

মায়ের পিতৃপরিবার ভরদ্বাজ গোত্রীয় অম্বোষ্ঠ বা বৈদ্য বংশোদ্ভূত। অন্যদিকে তাঁর মাতুল বংশ মৌলিক কায়স্থ। কূলমর্যাদায় মায়ের বাপের বাড়ি উঁচু হলেও, মামাবাড়ি ছিলো সামাজিক মর্যাদা ও অর্থকৌলীন্যে উঁচুতে।

আগেই বলেছি, আমার মায়ের জন্ম হয়েছিলো কলকাতায়। কিন্তু তাঁর মাত্র তিনমাস বয়সে এক আকস্মিক দুর্ঘটনায় তাঁর বাবা মারা যাওয়ার পর তাঁকে নিয়ে তাঁর মা চট্টগ্রামে ফিরে আসেন, এবং মা বড় হয়ে ওঠেন তাঁর মামাবাড়ি নাগবাড়িতে। এ বাড়ি থেকেই তাঁর বিয়ে হয় ১৯৫৫ সালে আমার বাবা নীরদ বরণ নন্দীর সঙ্গে। তখন তিনি ছিলেন মাত্র ১৯ বছরের তরুণী, সারোয়াতলীর পাশের গ্রাম কানুনগোপাড়ায় অবস্থিত স্যার আশুতোষ কলেজের আই.এ. দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী। বিয়ের অনেক বছর পরে মা আবার পড়াশোনা শুরু করে বি.এ. পাস করেন।

চট্টগ্রামের রাউজান উপজেলার সুলতানপুর গ্রামের নন্দীপাড়ায় বিয়ে হওয়ার পর কয়েক বছর মা আমার পিতামহ নারায়ণ চন্দ্র নন্দী প্রতিষ্ঠিত বালিকা উচ্চ

আমার অকাল্প্রয়াত শিশুপুত্রের সঙ্গে আমার বাবা-মা

বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন। কিন্তু পরে নিজের পরিবার ও সন্তানদের স্বার্থে শিক্ষকতা ছেড়ে দিয়ে সার্বক্ষণিক গৃহকর্মে আত্মনিয়োগ করেন।

মা বেঁচে থাকতেই ১৯৯৯-এ মাত্র ৩৯ বছর বয়সে মারা যায় তাঁর ছোটছেলে ডা. হিমাদ্রি শেখর নন্দী। তাঁর একটি নাতি– আমার শিশুপুত্র– মারা যায় ২০০৭-এ। এসব দুঃসহ শোক তিনি নীরবে সহ্য করেছেন। কিন্তু ২০১৪’র ১৭ এপ্রিল আমার বাবার মৃত্যু তাঁর চোখের সব বাতি যেন নিভিয়ে দিয়েছিলো। বাবা মারা যাওয়ার মাত্র তিন মাস তেরো দিন পর, ৩০ জুলাই তারিখে, মা ঢাকায় আমার বাসায় শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

আজ বিশ্ব মা দিবসে সবাই মাকে নিয়ে লিখছে, তাই আমিও দু কথা লিখলাম। এটা জলমগ্ন তুষারশৈলের ডগাটুকু মাত্র। সময়-সুযোগ পেলে মাকে কোনোদিন পূর্ণ মহিমায় আপনাদের সামনে নিয়ে আসতে পারবো, এই আশা রাখি।

You must be logged in to post a comment.