কবি নজরুল: স্মৃতির জানালায়

স্ত্রী প্রমীলা নজরুল, এবং দুই পুত্র সানি ওরফে কাজি সব্যসাচী ও নিনি ওরফে কাজি অনিরুদ্ধ-সহ কবি নজরুল
গত শতকের ষাটের দশকের গোড়ার দিকে আমার শিশুবয়সে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান (বর্তমান বাংলাদেশ) থেকে ঠাকুরমার সঙ্গে একাধিকবার কলকাতা গিয়েছি। চট্টগ্রামের পতেঙ্গা বিমানবন্দর থেকে ফকার ফ্রেন্ডশিপ গোছের ছোট বিমানে আমরা কলকাতার দমদম বিমানবন্দরে গিয়ে নামতাম। ১৯৬৫’র ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের যুদ্ধের পর তো দু দেশের মধ্যে যাতায়াত সেই যে বন্ধ হয়ে গেলো, সেটা খুললো ১৯৭১-এ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর।
তো তখন ভারতে গেলে প্রধান গন্তব্য হতো কলকাতা। সেখানে আমাদের বহু আত্মীয়-স্বজন। ঠাকুমা আর আমাকে ভাগাভাগি করে বিভিন্ন আত্মীয়ের বাড়িতে বা বাসায় আতিথ্য গ্রহণ করতে হতো।
এভাবে বেড়ানোর এক পর্বে আমারা উঠতাম ঠাকুমার ভাই, মানে আমার বাবার বড় মামার বাসায়। তিনি ছিলেন পশ্চিম বঙ্গ শিক্ষা বোর্ডের উচ্চপদস্থ আধিকারিক, এবং থাকতেন কলকাতার এন্টালি পদ্মপুকুর এলাকায় মধ্যবিত্তদের আবাসনের জন্যে ক্যালকাটা ইমপ্রুভমেন্ট ট্রাস্ট (সিআইটি)-এর তৈরি করা অসংখ্য ফ্ল্যাটবাড়ির একটিতে।
ফ্ল্যাটবাড়ি বলতে আহামরি কিছু ভাবার কোনো কারণ নেই। একচিলতে ব্যালকনিসহ দেড়খানা কামরা, রান্নাঘর, আর একটি বাথরুম– এই নিয়ে ছিলো ক্ষুদে এক-একটি ফ্ল্যাট। আমার ওই দাদুর নিজের বাড়ি ছিলো শহরতলীর দিকে। কিন্তু তিনি অফিস যাতায়াতের সুবিধের জন্যে এ বাসাতেই থাকতেন।
সিআইটি বিল্ডিংস নামে পরিিিচত ওই ভবনগুলোর একটার চারতলায় ছিলো দাদুর ফ্ল্যাট। আর হাত বিশ-পঁচিশ হাতের ব্যবধানে দাঁড়ানো পাশের আরেকটা সিআইটি বিল্ডিংয়ের চারতলায় ছিলো কার ফ্ল্যাট জানেন? স্বয়ং কবি কাজি নজরুল ইসলামের।
বয়োবৃদ্ধ, মানসিক ব্যাধিগ্রস্ত, অবোধ একটি শিশুর মতো অসহায় কবিকে নিয়ে ওই ছোট্ট দেড় কামরার বাসায় থাকতেন সপরিবারে তাঁর বড় ছেলে কাজি সব্যসাচী। শুনেছি, পশ্চিম বঙ্গ সরকার কৃপাপরবশ হয়ে ‘বিদ্রোহী কবি’-কে এই ফ্ল্যাট নামের খাঁচাখানা বরাদ্দ দিয়েছিলো বসবাসের জন্যে। কবি নিজে, পুত্র ও পুত্রবধূ, নাতি-নাতনি নিয়ে চার-পাঁচজনের ওই পরিবার কীভাবে ওই দেড় কামরার ভেতরে থাকতো, সেটা ভেবে এখন বিস্ময় বোধ করি, যদিও সে-বয়সে অত জটিল সমস্যা মাথায় খেলতো না।
দাদুর ফ্ল্যাটের জানালায় দাঁড়িয়ে শিশু আমি পরম কৌতুক আর অপরিসীম বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ্য করতাম– কীভাবে পাশের বিল্ডিংয়ে আমাদের সোজাসুজি ফ্ল্যাটের জানলায় দাঁড়িয়ে নজরুল কাগজের টুকরো কুচি কুচি করে ছিঁড়ে বাইরে হাওয়ায় ভাসিয়ে দিচ্ছেন, গোলা পাকিয়ে ছুঁড়ে দিচ্ছেন নিচে রাস্তায়।
কখনো জানালার শিক ধরে এমনিই দাঁড়িয়ে থাকতেন– দূর আকাশের দিকে নিরুদ্দেশ তাকিয়ে। অতল গভীর কালো জলের দিঘির মতো কবির বিশালায়ত দুটি চোখে ছায়া ফেলে যেতো আকাশে ভাসমান টুকরো মেঘ। কাশফুলের মতো সাদা ধবধবে কেশগুচ্ছ দুলে দুলে উঠতো দুপুরের দামাল হাওয়ার ঝাপটায়।
আর আমি ভীষণ… ভীষণ অবাক হয়ে ভাবতাম, ইনিই সেই কবি, যাঁর অসংখ্য কবিতা আমরা বইয়ে ছাপার অক্ষরে পড়ি, অনুষ্ঠানে আবৃত্তি করি, উত্তরপত্রে লিখে পরীক্ষায় পাস করি। ইনিই সেই কবি, যাঁর কবিতা আমাকে বিস্ময়ে, রোমাঞ্চে, আনন্দে অভিভূত করে। জীবনে সেটাই ছিলো আমার সত্যিকারের একজন কবিকে দেখা। পাড়ার পাতিকবি নয়– বাংলা কাব্যের মহীরুহ।
মাঝে মাঝে সমবয়সী আরো কয়েকজনের সঙ্গে কবির বাসায় চলে যেতাম। তাঁর কামরার বাইরে দাঁড়িয়ে দেখতাম, কেমন করে একটা থালায় ভাত মেখে গরাস করে মুখে তুলে কবিকে খাইয়ে দিচ্ছেন তাঁর পুত্রবধূ, ঠিক যেভাবে আমাকে খাইয়ে দেন আমার মা বা ঠাকুমা। ভাত খাইয়ে, মুখ ধুইয়ে মুছিয়ে তাঁকে বিছানায় শুইয়ে দেয়া হতো, একটা বড়সড় আকারের শিশুর মতোই। এসব দেখে কবিকে আমাদের সমবয়সী, আরো কাছের কেউ বলে আমাদের মনে হতো।
কিন্তু পরে যখন বয়স আরো বেড়েছে, দুনিয়ার হালচাল বুঝতে শিখেছি, তখন সিআইটি বিল্ডিংয়ের খাঁচায় কাজি নজরুল নামের এক বৃদ্ধ সিংহকে রাখাটা আমার বড় অপমানজনক মনে হয়েছে। সবসময় এটাই মনে হয়েছে যে, নজরুলের মতো একজন যুগন্ধর কবির এর চেয়ে বেশি পাওয়ার কথা ছিলো।

বাংলাদেশে নিয়ে আসার পর কবি নজরুলকে মাল্যভূষিত করে স্বাগত জানাচ্ছেন বঙ্গবন্ধু
পরে বাংলাদেশ স্বাধীন হওযার পর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ভারতের তৎকালীন প্রথান মন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে অনুরোধ করে বাংলাদেশে নিয়ে এলেন। তাঁর জন্যে বরাদ্দ করলেন ঢাকার বনেদি এলাকা ধানমণ্ডিতে বাগান-টাগান সুদ্দু সুন্দর একটা বাড়ি। ১৯৭৬ সালে সালে মারা যাওয়ার আগপর্যন্ত ওই বাড়িতে বেশ আরামেই ছিলেন কবি, যদি ভালো-মন্দ বোঝার মতো কোনো শক্তি তাঁর তখনও অবশিষ্ট থাকে। যিনি তাঁকে এ বাড়ি দিয়েছেন, সেই বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে যে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে, সেটাও নিশ্চয় ছিলো তাঁর জানার বা বোধ-বুদ্ধির বাইরে।
জাতির জনকের হত্যাকাণ্ডের পর ক্ষমতার পালাবদলের সূত্রে গদিয়ান শাসকেরা পরের বছর নজরুল মারা গেলে তাঁর পরিবারের সদস্যদের ওই বাড়ি থেকে বের করে দেয়। এই হলো আমাদের জাতীয় কবির প্রতি জাতির আচরণের নমুনা।
নজরুলকে নিয়ে ভারতে, বাংলাদেশে বিস্তর রাজনীতি, কূটনীতি, বাণিজ্য হয়েছে। তাঁকে সবাই নিজের নিজের সুবিধামতো ব্যবহার করে নিজের কাজ হাসিল করেছে। আর তাঁর দিকে ছুঁড়ে দিয়েছে চরম অনাদর অবহেলা। এসব ভেবে ভীষণ ক্ষোভ আর দুঃখ থেকে একটা কবিতা লিখেছিলাম আজ থেকে প্রায় পঁয়ত্রিশ বছর আগে, বিগত আশির দশকের মাঝামাঝি সময়ে। তারপর ওটা কোনো-একটা ক্ষুদে সাময়িকীতে (নাম মনে নেই) প্রকাশিতও হয়, কিন্তু লিখিত ও মুদ্রিত উভয় অনুলিপিই একসময় বেমালুম হারিয়ে যায়। দীর্ঘকাল পরে কবিতাটা স্মৃতি থেকে যথাসম্ভব পুনরুদ্ধার করলাম। নিজের লেখা কবিতা আমার বেশির ভাগই মনে থাকে না, কিন্তু অনতিদীর্ঘ এই গদ্যকবিতাটা কী করে যেন প্রায় অবিকৃত অবস্থায় মাথার মধ্যে থেকে গেছে, চিরবিস্মৃত না-হওয়ার দুর্মর ইচ্ছা নিয়েই!
চুরুলিয়া নয়, দুখু মিয়া
চুরুলিয়া নয়, দুখু মিয়া,
লুক্সেমবার্গ কিংবা সাসেক্স হলেই হয়তো ভালো হতো।
আটপৌরে বাঙালিরা খুব বেশি সঙ্গমক্ষম নয়;
আসলে সে যোগে-ভোগে কোথাও তেমন পারঙ্গম নয়।
কারণ সক্রিয় যথেচ্ছ সঙ্গমে সিফিলিস,
ক্রমে ক্রমে কালব্যাধি ন্যুরোসিফিলিস–
কিংবা ধরো, যোগীরাজের চেলা হয়ে কুলকুণ্ডলিনী জাগরণ–
এও এক অধ্যাত্ম আধি, দুখু মিয়া,
এসব আধিব্যাধি তো তোমার সাজে না!
তুমি এত উচ্চণ্ড উদ্দাম কেন হলে–
কুনকির স্রাবগন্ধে মাতাল গজেন্দ্রের মতো এতো উন্মাদ
কমেটপুচ্ছের মতো এতো বেশি উচ্ছ্বাসপ্রবণ, দুখু মিয়া?
তুমি তো বাঙালি কবি, যাদের উপমা অষ্টাদশ শতকের
টেক্সাসের ভারবাহী কাফ্রি ক্রীতদাসের নিঃশ্বাস,
মোগল রংমহলে হারেমবন্দিনীর চোখ নিংড়ানো লোনাজল!
বাঙালি কবিরা সে তো বিশ্বখ্যাত রুশ সার্কাসের ক্লাউন,
বাতাসের অনুকুলে তরী বা মেঘের মতো তরতরে
প্রশাসক প্রভুদের অনুগামী।
কবি দুখু মিয়া, তবু তুমি এলে!
তুমি ভুল দেশে ভুল সময়ের কেন হলে?
একদল তোমাকে ছুঁড়ে দেয়
নগর উন্নয়ন সংস্থার নির্লজ্জ নির্মাণ
ঠাসাঠাসি গাদাগাদি পায়রার খোপে।
অন্যদল তুড়িলাফে টেক্কা দেয়
রাজধানীর অভিজাত আবাসিক এলাকার হাওয়াই নির্জনে!
বিনিময়ে চিরকেলে বস্ত্র খুলে পাগলা দুখুকে দেয়
কিস্তিটুপি ইজের চাপকান।
হুররে, নজরুল সাহেব দেখি আজকাল
বাঙালি বা মানুষের চেয়েও একজন বড়সড় ঝুনো মুসলমান!
চৌত্রিশ বছর ধরে পৌরুষ রোগাক্রান্ত হে বিদ্রোহী কবি,
আমরা সব স্বেচ্ছায় বিস্মৃত আজ
মহাবিপ্লবের জন্মদাতা
আপনার পরাধীনতার ক্ষোভ, ক্রোধ, দ্রোহের যত ইতিকথা।
তাই সামরিক অভ্যুত্থান, প্রতিবিপ্লবে
নির্বিচার হত্যাকাণ্ড, পৈশাচিক খুনোখুনি সেরে
রক্তমাখা ধূর্ত শেয়ালের মত
আমরা হুক্কাহুয়ায় মাতি–
“আজ সৃষ্টিসুখের উল্লাসে”—!
সাড়ে তিন দশককাল ধরে হে বিরহী কবি,
এতদিনে আমরা সব ভুলে গেছি
আপনার মরমী প্রেমের মর্মকথা,
তাই চৌরাস্তায় ভাঙি আপনার প্রতিমূর্তি আপনারই কামানে,
বারুদের নোংরা ধোঁয়ায় মুছি অবিনাশী আপনার অক্ষর।
কবি দুখু মিয়া,
তবুও তো তুমি বাঙালির, বাংলার
প্রাণের কবি, মর্মের কবি–
সাকিন বর্ধমান, বঙ্গভূমি, গ্রাম চুরুলিয়া।
########