Loading

আনারকলি: সাদাত হাসান মান্টো’র গল্প

https://banglapro.xyz/wp-content/uploads/2023/09/7522835618_51c652ebd0_b.jpg

তার নাম ছিলো সেলিম, কিন্তু তার বন্ধুবান্ধবেরা তাকে বলতো শাহজাদা সেলিম। তার চেহারা সুরত মোগলাই ছিলো, সুশ্রী ছিলো– সম্ভবত এ কারণেই। তার হাবেভাবে গর্ব যেন ঝরে ঝরে পড়তো।

ওর বাবা ছিলো পিডবিøউডি অফিসের কর্মচারী। বেতন ছিলো খুব বেশি হলে একশ টাকা, কিন্তু থাকতো খুব ঠাটবাটের সাথে। ঘুষ খায় বলে শোনা যেতো। এ কারণেই সেলিম ভালোর চেয়েও ভালো কাপড় চোপড় পরতো আর তার পকেট খরচও মিলতো প্রচুর। কারণ সে ছিলো তার মা-বাবার একমাত্র সন্তান।

যখন সে কলেজের ছাত্র ছিলো, তখন অনেক মেয়ে তার প্রেমে পড়েছে, কিন্তু সে তাদের সঙ্গে শুধু প্রেমের ভান করেছে। শেষে তার চোখ গিয়ে পড়লো এক চপলা চঞ্চলা সুন্দরী তরুণীর উপর, যার নাম ছিলো সীমা। সে তার সঙ্গে একটা সম্পর্ক তৈরি করতে চাইলো। তার দৃঢ়বিশ্বাস ছিলো যে, মেয়েটার নেকনজর তার উপর পড়বেই। না, সে এতদূরও ভেবেছিলো যে, সীমা তার পায়ে এসে পড়বে এবং সেলিম যে ওকে প্রেমের দৃষ্টিতে দেখেছে তাতে ধন্য আর কৃতজ্ঞ বোধ করবে।

কলেজে একদিন প্রথম বারের মতো সীমার মখোমুখি হয়ে সেলিম বললো, “আপনি এতগুলো বইয়ের বোঝা বইছেন। নিন, ওগুলো আমাকে দিয়ে দিন। বাইরে আমার টাঙ্গা দাঁড়িয়ে আছে, আপনাকে আর আপনার এই বোঝাকে আপনার ঘর পর্যন্ত পৌঁছে দেবে।”

সীমা তার মোটা মোটা বইগুলো বগলে চেপে নিয়ে বড় শুকনো গলায় বললো, “আপনারে সাহায্যের কোনো প্রয়োজন আমার নেই। যাই হোক, তারপরও আপনাকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি।”

শাহজাদা সেলিম তার জীবনের সবচেয়ে বড় একটা আঘাত পেলো। অপমানটা হজম করার জন্যে সে কয়েক মুহূর্ত সময় নিলো। তারপর সীমাকে বললো, “মহিলাদের পুরুষের সাহায্য নেয়ার দরকার হয়। আমি ভেবে পাচ্ছি না, আমার প্রস্তাবটাকে আপনি এভাবে প্রত্যাখ্যান করলেন কেন?”

সীমার গলার স্বর আরো শুকনো হয়ে গেলো, “মহিলাদের পুরুষের সাহায্য দরকার হয় বটে, কিন্তু এ মুহূর্তে আমার তেমন কোনো প্রয়োজন আছে বলে মনে হচ্ছে না। আপনার প্রস্তাবের জন্যে শুকরিয়া তো আমি আগেই জানিয়ে দিয়েছি। এর চেয়ে বেশি আর কী চান আপনি?”

এই বলে সীমা চলে গেলো। শাহজাদা সেলিম, যে আনারকলির স্বপ্ন দেখছিলো, চোখ পিটপিট করে তাকিয়ে ওখানেই দাঁড়িয়ে রইলো। খুবই খারাপভাবে হেরে গিয়েছিলো সে।

এর আগে সেলিমের জীবনে যে-কজন মেয়ে এসেছে, তারা চলেছে তার ভুরুর ইশারায়। কিন্তু এই সীমা নিজেকে কী ভাবে, “এতে কোনো সন্দেহ নেই যে যে-কজন সুন্দরী মেয়ে আমি দেখেছি, তাদের মধ্যে এ-ই সবচেয়ে বেশি সুন্দর। কিন্তু আমাকে প্রত্যখ্যান করা, এ তো বড্ড বাড়াবাড়ি! আমি তো এর বদলা নেবোই, তা সে যা হয় হবে।”

সীমার ব্যবহারের প্রতিশোধ নেয়ার জন্যে শাহজাদা সেলিম বেশকিছু স্কিম বানালো, কিন্তু কোনোটাই ফলপ্রসূ বলে প্রমাণিত হলো না। সে সীমার নাকটা কেটে নেয়ার কথা পর্যন্ত ভেবেছিলো। এ অন্যায়টা সে করেই ফেলতো, কিন্তু সীমার চেহারায় তার নাকটা সেলিমের খুব পছন্দ ছিলো। কোনো চিত্রকরও এমন নাকের ছবি আঁকার কথা কল্পনা করতে পারতো না।

সেলিম তার ইচ্ছে পূরণ করতে পারলো না বটে, কিন্তু ভাগ্য তাকে সাহায্য করলো। তার মা তার বিয়ের জন্যে কনে খোঁজা শুরু করে দিলেন, আর শেষপর্যন্ত তাঁর পছন্দের নজরটা সীমার ওপর গিয়েই পড়লো, যে ছিলো তাঁর সইয়ের মেয়ে।

বিয়ের কথা পাকা হয়ে গেলো, কিন্তু সেলিম বিয়ে করতে অস্বীকার করে বসলো। এতে তার বাবা-মা খুবই অসন্তুষ্ট হলেন। দশ-বারো দিন ধরে ঘরে হাঙ্গামা চললো। সেলিমের বাবা ছিলেন খুব কড়া মেজাজের মানুষ। তিনি ছেলেকে বললেন, “দেখো, আমাদের সিদ্ধান্ত তোমাকে মেনে নিতে হবে।”

সেলিমের মাথাও গরম হয়ে গেলো। সে জবাব দিলো, “আপনার সিদ্ধান্ত কোনো হাইকোর্টের রায় নয়। আর আমি কী অপরাধ করেছি যে, আপনি আমাকে রায় শোনাচ্ছেন?”

এ কথা শুনে তার বাবা ফুঁসে উঠলেন, “তোমার অপরাধ হলো নিজের বাপ-মায়ের কথার অবাধ্য হওয়া। আদেশ অমান্য করছো তুমি। তোমার সাথে সব সম্পর্ক আমরা ছিন্ন করে ফেলবো।”

সেলিমের জোশ ঠান্ডা হয়ে গেলো, “কিন্তু আব্বাজান, আমার শাদি তো আমার মর্জি মাফিকই হওয়া উচিত!”

“বলো, তোমার মর্জিটা কী?”

“আপনি ঠান্ডা মাথায় শুনলে, তবেই আমি বলবো।”

“আমার মাথা যথেষ্ট ঠান্ডা আছে। তোমার যা কিছু বলার আছে, তাড়াতাড়ি বলে ফেলো। আমি বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে পারবো না।”

সেলিম থেমে থেমে বললো, “আমি… আমি একটা মেয়েকে ভালোবাসি।”

তার বাবা গর্জে উঠলেন, “কোন্ মেয়েকে?”

সেলিম খানিকটা ইতস্তত করে বললো, “ সে একজন আছে…”

“কে সে? নাম কী?”

“সীমা… আমার সঙ্গে কলেজে পড়তো।”

“মিয়াঁ ইফতিখার উদ্দিনের মেয়ে?”

“জী হ্যাঁ, ওর নাম সীমা ইফতিখার। মনে হচ্ছে সে-ই হবে।”

তার বাবা হঠাৎ বেদম হাসিতে ফেটে পড়লেন, “আরে বেটা মনে হচ্ছের বাচ্চা, ওই মেয়েটার সঙ্গেই তোমার বিয়ের কথা দিয়েছি। সে তোমাকে পছন্দ করে তো?”

সেলিম ভেবে কুল পাচ্ছিলো না, এমন ঘটনাক্রম কী করে হয়ে গেলো। সে বুঝতে পারছিলো না তার বাবা সত্য বলছেন, নাকি মিথ্যে।

এদিকে সেলিমের বাবা তাকে যে প্রশ্ন করেছিলেন, তখনও তার উত্তর পান নি। তাই তিনি আবার জিজ্ঞেস করলেন, “সেলিম, আমাকে বলো সীমা তোমাকে পছন্দ করে কিনা?”

সেলিম বললো, “জী না।”

“সেটা তুমি জানলে কী করে?”

“ওর সঙ্গে… ওর সঙ্গে আমি একবার মুখোমুখি কথা বলে প্রেম নিবেদন করেছিলাম। “কিন্তু সে আমাকে…”

“তোমাকে তার প্রেমের যোগ্য মনে করে নি।”

“জী হ্যাঁ, বড় খারাপভাবে প্রত্যাখ্যান করেছে।”

সেলিমের বাবা খানিকক্ষণ তাঁর টাক মাথা চুলকিয়ে বললেন, “তাহলে তো এ বিয়ে হওয়া উচিত না। আমি তোমার মাকে বলছি মেয়েদের পরিবারকে যেন জানিয়ে দেন যে, ছেলে রাজি না।”

সেলিম একদম আবেগ ভারাক্রান্ত হয়ে গেলো, “না, আব্বাজান, এরকম করবেন না। শাদি হয়ে গেলে সব ঠিক হয়ে যাবে। আমি তাকে ভালোবাসবো আর কারো ভালোবাসা বিফলে যায় না। কিন্তু আপনাদেরকে… মানে আমি বলতে চাইছি যে, সীমা যেন এটা জানতে না পারে যে, যাকে সে এমন উপেক্ষা আর অবহেলা দেখিয়েছে, তার সঙ্গেই তার বিয়ে হচ্ছে।”

তার বাবা নিজের টাক মাথায় হাত বুলোতে বুলোতে বললেন, “আমি এ ব্যাপারে চিন্তা করবো।”

এই বলে উনি চলে গেলেন। তাঁকে এক ঠিকাদারের কাছ থেকে ঘুষ আদায় করতে হবে, ছেলের বিয়ের খরচ মেটানোর জন্যে। শাহজাদা সেলিম রাতে যখন ঘুমোনোর জন্যে তার খাটে শুলো, তার চোখে ভেসে উঠলো আনারকলির কলিগুলো। সারা রাত ধরে সেলিম মেয়েটার স্বপ্ন দেখতে লাগলো।

ঘোড়ায় চড়ে সে বাগানে পৌঁছেছে, শাহী পোশাক পরে। তেজি অশ^ থেকে নেমে সে বাগানের ভেতরকার একটা পথ ধরে এগিয়ে যাচ্ছে।

যেতে যেতে দেখতে পেলো, সীমা একটা আনার গাছের সবচেয়ে উপরের ডাল থেকে একটা নতুন ফোটা কলি ছিঁড়ে নেয়ার চেষ্টা করছে। তার মোটা মোটা বইগুলো মাটিতে ছড়িয়ে পড়ে আছে। তার চুলগুলো আলুথালু হযে পড়েছে, আর সে লাফিয়ে লাফিয়ে ওই উঁচু ডালটা পর্যন্ত তার হাত পৌঁছানোর চেষ্টা করেও বার বার ব্যর্থ হচ্ছে।

সেলিম তার দিকে এগিয়ে গেলো। তারপর আনারের ঝোপের পেছনে লুকিয়ে ওই ডালটাকে নিচের দিকে টেনে ধরলো। সীমা সেই কলিটা ছিঁড়ে নিলো, যেটার জন্যে সে এতক্ষণ ধরে এত চেষ্টা করছিলো। কিন্তু সাথে সাথেই তার মনে ভাবনা এলো, ডালটা নিচে নামলো কী করে।

সে এখন ভাবছিলো যে, শাহজাদা সেলিম তার কাছে পৌঁছে গেছে। সীমা ঘাবড়ে গেলো, কিন্তু সামলে নিয়ে বইগুলো মাটি থেকে উঠিয়ে নিয়ে নিজের বগলের নিচে চেপে রাখলো। আনারকলি তার চুলগুলো জড়ো করে শক্ত করে খোঁপায় বেঁধে নিয়ে শুকনো গলায় এই বলে চলে গেলো, “আপনার সাহায্যের কোনো প্রয়োজন আমার ছিলো না, তারপরও আপনাকে ধন্যবাদ জানিয়ে যাচ্ছি।”

রাতভর সে এ ধরনের স্বপ্ন দেখতে লাগলো। সীমা আর তার মোটা মোটা বই, আনার ফুলের কলি আর শাদির ধুমধাম।

বিয়ে হয়ে গেলো। বিয়ের উৎসব চলাকালে শাহজাদা সেলিম তার আনারকলিকে একঝলক দেখারও সুযোগ পেলো না। সেই শুভলগ্নের জন্যে ধড়ফড় করছিলো সে, যখন সীমা তার বাহুপাশে ধরা দেবে। সে তাকে এমন ভালোবাসবে যে, বিরক্ত হয়ে সে কান্না শুরু করে দেবে।

ক্রন্দসী মেয়েদের সেলিম খুব পছন্দ করতো। তার ফিলোসফি ছিলো, নারী যখন কাঁদে তখন সে আরো সুন্দরী হয়ে ওঠে। তাদের অশ্রু্বিন্দু হলো শিশিরবিন্দুর মতো, যা পুরুষের আবেগের ফুলের ওপর ঝরে পড়লে তার এমন স্বস্তি আর সুখ মেলে, যা আর কোনো সময়ে ভাগ্যে জুটতে পারে না।

রাত দশটার সময় কনেকে বাসর ঘরে নিয়ে যাওয়া হলো। সেলিমেরও অনুমতি মিলে গেলো ওই কামরায় যাওয়ার। মেয়েরা কাল মলা, নাক মলা ইত্যদি রঙ্গরসিকতা আর নিয়ম-কানুনের পালা শেষ করে বিদায় নিলে সেলিম কামরার দরজা বন্ধ করে দিলো। মাথায় লম্বা ঘোমটা টানা কনে ফুল দিয়ে সাজানো পালঙ্কের ওপর বসে ছিলো রেশমি কাপড়ে মোড়া একটা পোঁটলার মতো। ফুলগুলো যাতে আনার ফুলের কলি হয়, সেজন্যে সেলিম বিশেষ ব্যবস্থা করেছিলো। সে ধুকপুক করতে থাকা হৃদয়ে এগিয়ে গিয়ে পালঙ্কে কনের পাশে বসে পড়লো।

অনেকক্ষণ পর্যন্ত সে তার বিবির সঙ্গে কোনো কথা বলতে পারলো না। তার মনে হচ্ছিলো, বউয়ের বগলের নিচে সম্ভবত বইপত্র আছে, যেগুলো সে নিতে দেবে না। শেষপর্যন্ত সে অনেক সাহস করে বললো, “সীমা…”

নামটা উচ্চারণের সাথে সাথেই তার গলা শুকিয়ে গেলো। কিন্তু তারপরও আবার সাহস সঞ্চয় করে নিজের দুলহনের মুখ থেকে ঘোমটা সরিয়ে তার মুখ দেখেই ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলো– এ তো সীমা নয়, অন্য কোনো মেয়ে! তার মনে হলো, আনার ফুলের সমস্ত কলি শুকিয়ে গিয়েছে।

You must be logged in to post a comment.